সারজিস আলম এবং ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন: ঢাকা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের যাত্রা
আন্দোলন থেকে অসহযোগ আন্দোলনে ঢাকা, বাংলাদেশ– ২ জুলাই ১৯৯৮ সালে পঞ্চগড় জেলায় জন্মগ্রহণকারী সারজিস আলম বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যে এক উল্লেখযোগ্য নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন শক্তিশালী নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত, সারজিস আলম ২০২৪ সালের বাংলাদেশ কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছেন। এই আন্দোলন তার নেতৃত্বে এক উত্তাল সময়ে প্রবাহিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের দিকে ধাবিত হয়।
বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরেই চলমান। ১৯৭০-এর দশকে শুরু হওয়া এই কোটা ব্যবস্থা, সরকারি চাকরিতে কিছু নির্দিষ্ট অংশের জন্য নির্ধারিত কোটা প্রথার মাধ্যমে বিভিন্ন বৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছিল। তবে, বাস্তবে এই ব্যবস্থা অনেক সময় অনিয়ম এবং অনান্য অসঙ্গতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত, শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোটা প্রথার ব্যাপক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলন প্রমাণিত করেছিল যে, কোটা ব্যবস্থার অব্যাহত অসঙ্গতি এবং দুর্নীতি মোকাবেলা করতে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ছাত্ররা তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি কোটা সংস্কারের দাবিতে সড়কে নেমে আসে। যদিও কিছু ক্ষেত্রে সাড়া পাওয়া যায়, কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান হয়নি।
সারজিস আলম ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে আসেন, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তোলপাড় হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হিসেবে, সারজিস আলমের নেতৃত্বে এই আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। তিনি কোটা সংস্কারের জন্য একটি সুসংগঠিত, শক্তিশালী এবং অঙ্গীকারবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানান।
তার নেতৃত্বে, আন্দোলনটি একদিকে যেমন বৃহত্তর জনগণের সমর্থন লাভ করে, অন্যদিকে তেমনি সরকারী বেকারত্ব এবং কোটা ব্যবস্থার নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি শক্তিশালী মঞ্চে পরিণত হয়। সারজিস আলমের নেতৃত্বে ছাত্ররা সরকারী দফতরের সামনে প্রতিবাদ মঞ্চ গড়ে তোলে এবং কোটা সংস্কারের সুনির্দিষ্ট দাবির সাথে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের দাবিও তোলেন।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের দিকে, সারজিস আলমের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশে এক বিশাল রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে। আন্দোলনকারীরা সরকারি অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। সারজিস আলমের দৃঢ়তা এবং সংগঠনের দক্ষতা আন্দোলনটিকে আরও বিশাল আকার ধারণ করতে সাহায্য করে।
এ সময় আন্দোলনকারীরা সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন, যার মধ্যে রয়েছে ন্যায়বিচারের অভাব, দুর্নীতি এবং গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। এসব অভিযোগে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন লাভ করে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন সারজিস আলমের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা একটি অসহযোগ আন্দোলনে প্রবেশ করে। তারা সরকারী অফিসে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়, সরকারি সেবা বর্জন করে এবং বিভিন্ন জনমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই অসহযোগ আন্দোলন দ্রুত দেশের রাজনৈতিক আকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কট সৃষ্টি করে।
সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করা হলেও, সারজিস আলমের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি থেকে এক চুলও সরে আসেননি। এদিকে, দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নিশ্চিত হন যে, এই আন্দোলন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সক্ষম।
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে, সারজিস আলমের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ও কোটা সংস্কারের দাবির সাথে অন্যান্য জনগণ যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের দাবিতে মিছিল এবং বিক্ষোভে অংশ নেয়। সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগণের প্রতিবাদ এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চাপের মুখে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার চরম চাপের সম্মুখীন হয়।
এমন পরিস্থিতিতে, সরকার পতনের দাবিতে দেশজুড়ে নানা রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ জনগণ সুর চড়ায়। আন্দোলনের মাত্রা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে কোটা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
সারজিস আলমের নেতৃত্বে এই আন্দোলন এক অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। তার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং সংগঠনের ক্ষমতা আন্দোলনকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। তবে, এটি শুধুমাত্র একটি আন্দোলনের সাফল্য নয়, বরং এটি একটি উদাহরণ যে কিভাবে ছাত্রদের উদ্যোগ ও সংগঠন রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হতে পারে।
সারজিস আলমের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং তার পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। এটি একদিকে যেমন একটি সাফল্যের গল্প, অন্যদিকে তেমনি একটি সতর্ক সংকেতও যে, রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা কখনও নীরব থাকে না।
যদিও বর্তমান পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে, তবে দেশের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই আন্দোলনের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। সারজিস আলমের নেতৃত্বে এই আন্দোলন বাংলাদেশের ছাত্র ও জনগণের আত্মবিশ্বাস এবং সংগঠনের শক্তির একটি উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হবে।